★★ ঢাকা যে দলের দখলে ক্ষমতা তাদের—১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই এমন ধারণা বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীনের পর ৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠন ৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট সপরিবারে হত্যা এর পর থেকে সেনা ও সইরা শাসন। সইরা শাসন থেকে গনতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সকল দল ঢাকার রাজপথ দখল করে। তখন যুবলীগ কর্মী নুর হোসেন বদুর সহ অনেকের রক্তের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে । এর পর থেকে বাংলাদেশে যতগুলি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে, সকল নির্বাচনে ঘটেছে একই ঘটনা। তা হলো ঢাকা মহানগর যে রাজনৈতিক দলের দখলে গেছে, সে দল জিতেছে নির্বাচনে । সরকার গঠন তাঁরাই করেছেন।
রাজধানী ঢাকার আসন গুলিকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শক্তির উৎস হিসেবে ধরা হয়। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর আসনগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে এ ক্ষেত্রে একটি জিনিস বারবার দেখা গেছে গোটা দেশের ভোটারেরা ঢাকার আসনগুলিতে প্রভাব বিস্তার করেছে।
সারা দেশের শিক্ষিত, উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্ত শ্রেণির ভোট দেওয়ার প্রবণতা সেদিকে গিয়েছে। এটাকে এক ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাবাদ বলা যায়।
দেশের যে কোনো নির্বাচনী আসনে ভোটাররা প্রার্থীর সঙ্গে এলাকার যোগাযোগ ও ভালো মন্দ বিচার করে ৩০ থেকে ৪০% মানুষ ভোট দেন। সেখানেও অনেক সময় মার্কার চেয়ে প্রার্থী প্রাধান্য পায়, কিন্তু ঢাকায় এমনটি দেখা যায় না। ঢাকায় মার্কা আর রাজনৈতিক হাওয়া কাজে লাগিয়ে জয় পাওয়া যায়। ঢাকার নাগরিকেরা মার্কা আর প্রার্থীর শক্তি দেখে ভোট দেন।’
ড. কামাল হোসেনকে সবাই শ্রদ্ধা করে। তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন শিক্ষিত, তাঁকে যোগ্য রাজনীতিক হিসেবে সবাই জানে। কিন্তু ১৯৯১ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে জান বিএনপির অপরিচিত এক প্রার্থীর কাছে। শিক্ষিত ও যোগ্য হিসেবে সেই প্রার্থীর সুনাম ছিল না। কিন্তু তিনি হেরে গিয়েছিলেন সেই প্রার্থীর সাথে। ১৯৯৬ নির্বাচনে নিজের দল থেকে নির্বাচন করেন ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুরের আসনটি থেকে। কিন্তু তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
এই ঢাকার ভোটাররা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে “স্বৈরাচার” উপাধি দিলো আবার ২০০৮ সালের নির্বাচনে গুলশান-বনানীর আসনে বিপুল ভোটে জিতেছিলেন।’
১৯৯১ ও ২০০১ সাধারণ নির্বাচনে ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশে আসন ছিল ১৩ টি। এগুলো হচ্ছে-ঢাকা-১ (দোহার), ঢাকা-২ (নবাবগঞ্জ), ঢাকা-৩ (কেরানীগঞ্জ), ঢাকা-৪ (ডেমরা-শ্যামপুর), ঢাকা-৫ (গুলশান-ক্যান্টনমেন্ট-উত্তরা), ঢাকা-৬ (মতিঝিল-সবুজবাগ), ঢাকা-৭ (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি), ঢাকা-৮ (লালবাগ-হাজারিবাগ), ঢাকা-৯ (ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর), ঢাকা-১০ (তেজগাঁও-রমনা), ঢাকা-১১ (মিরপুর), ঢাকা-১২ (সাভার), ঢাকা-১৩ (ধামরাই)। ১৯৯১ ২০০১ সালের দুই টি সাধারণ নির্বাচনে জিতে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে । ঢাকার ১৩ আসনের সিংহভাগ তাদের দখলে গেছে।
১৯৯৬ সালে ঢাকার ১৩ আসনের ১২ টিতে আওয়ামীলীগ জিতে ও ২০০৮ সালের অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ঢাকার আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়ী হয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাগ করা নতুন ২০ আসনে। ঢাকার প্রতিটি নির্বাচনে পরিবর্তন হয়েছে, দুই দলের। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে ঢাকার ১৩ আসনের মধ্যে ৪ টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন দুই নেত্রী। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে নির্বাচন করেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নির্বাচন করেছিলেন ৩ টিতে। শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের একটি আসনের বাইরে ছিলেন ঢাকা-৭ ও ঢাকা-১০ আসনে।
খালেদা জিয়া ফেনি, বগুড়া ও চট্টগ্রামের তিনটি আসনের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন ঢাকা-৫ ও ঢাকা-৯ আসনে। ঢাকায় নির্বাচনী ফল খালেদা জিয়ার পক্ষে গেলেও শেখ হাসিনা দুইটি আসনে হেরেছেন নবীন প্রার্থীর কাছে। ১৯৯১ সালে ঢাকার সব কটি আসন বিএনপির পেয়েছিল। ঢাকায় শেখ হাসিনা ছাড়াও হেরেছিল আওয়ামী লীগের মোস্তফা মহসীন মন্টু, সাজেদা চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন ও মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের মতো নেতারা। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরের রাজনীতিতে দুই হেভিওয়েটের জন্ম দেয়-মির্জা আব্বাস (ঢাকা-৬) আর সাদেক হোসেন খোকা (ঢাকা-৭)। বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যে অন্যতম ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, আবদুল মান্নান খান ও মেজর মান্নান সহ অন্য নেতৃবৃন্দ
সাদেক হোসেন খোকা ও মেজর মান্নানের কাছে হেরেছিল শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়া হারিয়েছেন সাহারা খাতুন ও সাজেদা চৌধুরীকে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এক তরফা নির্বাচনে বিএনপি ঢাকার সব কটি আসন জয় লাভ করে বিএনপি। আওয়ামীলীগ সহ অন্য দলগুলোর আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়ে বিএনপি। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ঢাকায় ভোটের রাজনীতি অনেকটা পরিবর্তন হয়। সেই নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরেও ঢাকার ১৩ টি আসনের মধ্যে ৫ টি আসনে বিএনপি জয় লাভ করে। অন্য আসনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ।
২০০১ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিএনপি ঢাকার সব কটি আসনে জয় পায় বিএনপি । আগের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের কাছে হারের মধুর প্রতিশোধ নিলো বিএনপির প্রার্থীরা।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর যখন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন ঢাকার আসন বাড়িয়ে ২০টি করা হয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে । ঢাকার ১-২০ প্রতিটি আসনে জয় পায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। আসন বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার আসনগুলিতে অনেক নতুন মুখের দেখা মেলে।
আসছে সংসদ নির্বাচনে এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা অনেকের। তবে এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় দুর্বলতা।‘আমি মনে করি এটা খুব সুস্থ কোনো ধারা নয়।গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এটি ভালো নয়।’