লক্ষ্মীপুরের দর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নে আবুল কালাম জহির (৫০) নামে এক স্থানীয় বিএনপি নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ইউনিয়নের পশ্চিম লতিফপুর গ্রামে সড়কের ওপর এ নৃশংস হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত জহির চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
স্থানীয়রা জানান, রাতের দিকে পশ্চিম লতিফপুর গ্রামের মোস্তফার দোকান এলাকার সড়কটি সাধারণত শান্ত থাকে। তবে ওই রাতে হঠাৎ লোকজনের চিৎকার শুনে তারা ঘটনাস্থলে ছুটে গেলে জহিরকে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের গুরুতর আঘাতের চিহ্ন ছিল। স্থানীয়দের ধারণা, দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে পথরোধ করে তাকে একাধিকবার কুপিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসাও উদ্ধার করেছে। তবে হত্যাকাণ্ডে আসলে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল কি না, সেই প্রশ্ন এখনো স্পষ্ট নয়। স্থানীয়দের অনেকে ধারণা করছেন, আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দুর্বৃত্তরা গুলি চালিয়ে থাকতে পারে, আবার কেউ কেউ বলছেন—গুলির খোসা ঘটনাস্থলে রেখে হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন দিকে নেওয়ার চেষ্টা করা হতে পারে। পুলিশ বলছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানা যায়, একসময় জহির মাদক ও মাটির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন অভিযোগ ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি সেসব কর্মকাণ্ড থেকে সরে এসে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। বিএনপির স্থানীয় রাজনীতিতেও তিনি নিয়মিত অংশ নিয়ে আসছিলেন। তার ঘনিষ্ঠদের মতে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ঠিকঠাক রেখে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাই ছিল তার লক্ষ্য।
তবে গ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তার বিরোধ ছিল বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। বিশেষ করে স্থানীয় আরেক দলীয় বাহিনীর সঙ্গে টানাপোড়েন দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছিল। রাজনৈতিক হোক বা সামাজিক এ বিরোধই শেষ পর্যন্ত তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ালো বলে ধারণা করছেন এলাকাবাসী।
চন্দ্রগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ফয়জুল আজিম নোমান বলেন, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, আবুল কালাম জহির ওরফে মাটি জহির নামে পরিচিত এ ব্যক্তি নিজেও অতীতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি কাউসারের সঙ্গে তার অভ্যন্তরীণ বিরোধ চলছিল। কয়েকদিন আগে একটি খেলার মাঠে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে নতুন উত্তেজনা তৈরি হয়। সেই বিরোধের জের ধরেই কাউসারের অনুসারীরা এ হামলা চালিয়ে থাকতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি।
তবে পুলিশ এখনো কোনো পক্ষকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়ী করেনি। ওসি নোমান বলেন, এটি প্রাথমিক অনুমান মাত্র। হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্য উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা আছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না।
এদিকে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি বেলাল হোসেন বলেন, এ মুহূর্তে ঘটনাটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। আমাদের স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। জহির বেশ সক্রিয় ছিলেন, তাই কারা এ হামলা করেছে বা এর পেছনে কী উদ্দেশ্য সেটা পরিষ্কার নয়।
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক অঙ্গনকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। আমরা চাই দ্রুত তদন্ত হোক এবং প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হোক।
নিহত জহিরের স্বজনরা শোকে ভেঙে পড়েছেন। পরিবারের একজন সদস্য বলেন, তিনি সাধারণ রাজনীতি করতেন, কারও ক্ষতি করেননি। আগের ভুল থেকে বের হয়ে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
তবে তারা কারো নাম উল্লেখ করেননি। পরিবারের দাবি অভিযুক্তদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হোক।
ঘটনার পর থেকেই পশ্চিম লতিফপুর গ্রামে ভয় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সন্ধ্যার পরে সাধারণত ব্যস্ত থাকা গ্রাম্য বাজারটি প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। অনেকে বলেন, এলাকায় কিছুদিন ধরে উত্তেজনা বাড়ছিল। দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ ও প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা নতুন নয়। এবার তা হত্যাকাণ্ডে রূপ নিল।
গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের মতে, বছরখানেক ধরে এলাকাজুড়ে ছোটখাটো সংঘর্ষ, হুমকি–ধামকি ও ক্ষমতার লড়াই চলছিল। এতে সাধারণ মানুষও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন।
চন্দ্রগঞ্জ থানা পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থল পরিদর্শন, মরদেহ উদ্ধার ও প্রাথমিক আলামত সংগ্রহের পর তদন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। এলাকাজুড়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, নেওয়া হচ্ছে স্থানীয়দের বয়ান। হত্যাকাণ্ডের স্থানটির আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেলে তা বিশ্লেষণ করা হবে।
ওসি নোমান বলেন, দুর্বৃত্তরা একাধিক ব্যক্তি ছিল বলে ধারণা। হত্যার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এটি পরিকল্পিত ও হঠাৎ নয়। আমরা ঘটনাটি খুব গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছি।
লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জে আবুল কালাম জহির হত্যাকাণ্ড শুধু একজন রাজনৈতিক কর্মীকে হারানোর ঘটনা নয় এটি স্থানীয় এলাকায় দীর্ঘদিনের সংঘাত, প্রভাব বিস্তার এবং অপরাধচক্রের বাস্তবতাকে আবার সামনে এনে দিয়েছে। পুলিশ তদন্ত শেষ না করা পর্যন্ত প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট উত্তর পাওয়া না গেলেও এলাকাবাসী এখন একটাই চায়—অপরাধীরা যেই হোক, আইনের আওতায় আসুক। সূত্রঃ আমার সংবাদ
![]()