নিউজ ডেস্কঃ মানুষ ভুল করবে এটাই তার স্বভাব। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, সে মাঝে মাঝে পাপের পথে পা বাড়ায়, ভুলে যায় নিজের সীমা, মগ্ন হয় দুনিয়ার মোহে। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য সেই ভুলের দরজা বন্ধ করেননি। বরং তিনি প্রতিদিন ডেকে যান তুমি ফিরে এসো, আমি ক্ষমা করতে ভালোবাসি। এই ফিরে আসার নামই তওবা, আর ক্ষমা প্রার্থনার নাম ইস্তিগফার।
তওবা ও ইস্তিগফারের অর্থ : ‘তওবা’ শব্দটি আরবি তাওবা মূলধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। অর্থাৎ, পাপের পথ থেকে ফিরে আল্লাহর দিকে আসা। আর ইস্তিগফার শব্দের অর্থ হচ্ছে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া, ক্ষমার পোশাক চেয়ে নেওয়া। ইস্তিগফার মানে শুধু মুখে বলা “আস্তাগফিরুল্লাহ” নয়, এর মধ্যে আছে অনুশোচনা, আত্মসমালোচনা এবং পুনরায় ভুল না করার দৃঢ় সংকল্প।
কুরআনে তওবা ও ইস্তিগফারের গুরুত্ব
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে অসংখ্য স্থানে তওবা ও ইস্তিগফারের কথা বলেছেন। সূরা আন-নূর (২৪:৩১) এ বলা হয়েছে, তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা কর, হে মুমিনগণ, যাতে তোমরা সফল হও।
আবার সূরা হুদে (১১:৩) আল্লাহ বলেন, তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ক্ষমা চাও, তারপর তাঁর দিকে ফিরে এসো, তাহলে তিনি তোমাদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সুন্দর জীবনযাপন করাবেন এবং প্রত্যেক সৎকর্মশীলকে তাঁর প্রাপ্য পুরস্কার দেবেন।
অর্থাৎ, ইস্তিগফার ও তওবা শুধু আখিরাতের মুক্তির পথ নয়, দুনিয়ার সুখ-সমৃদ্ধিরও চাবিকাঠি।
রাসুল (সা.) এর জীবনে তওবা ও ইস্তিগফার
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন নিরপরাধ, পাপমুক্ত। তবুও তিনি দিনে ৭০ থেকে ১০০ বার পর্যন্ত ইস্তিগফার করতেন। সাহাবিদের কাছে তিনি বলতেন, আমি দিনে সত্তরবারেরও বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই ও তাঁর কাছে তওবা করি। (সহিহ বুখারি)
নবী কারিম (সা.) বলতেন, যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তিগফার পড়ে, আল্লাহ তার সব সংকট থেকে মুক্তির পথ তৈরি করে দেন, দুঃখ থেকে তাকে নিরাপদে রাখেন এবং এমন জায়গা থেকে রিজিক দেন, যা সে কল্পনাও করে না। (আবু দাউদ)
রাসুল (সা.) যদি প্রতিনিয়ত ক্ষমা চান, তাহলে আমরা যারা সীমাহীন ভুলে ভরা মানুষ আমাদের জন্য ইস্তিগফার কত প্রয়োজন, তা সহজেই অনুমেয়।
তওবা ও ইস্তিগফারের ফজিলত
ইস্তিগফার এমন এক আমল, যা পাপ মোচন করে, মনকে পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর রহমতের দ্বার খুলে দেয়। হজরত নূহ (আ.) তাঁর জাতিকে উপদেশ দিয়েছিলেন, তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ক্ষমা চাও, নিশ্চয়ই তিনি অতীব ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান বৃদ্ধি করবেন, তোমাদের জন্য উদ্যান সৃষ্টি করবেন এবং তোমাদের জন্য নদী প্রবাহিত করবেন। (সূরা নূহ: ১০–১২)
অর্থাৎ, ইস্তিগফার শুধু আত্মার মুক্তিই দেয় না, বরং জীবনের বরকত, রিজিকের প্রাচুর্য ও সমাজের কল্যাণও বয়ে আনে।
একজন আলেম বলেছিলেন, যে ব্যক্তি ইস্তিগফারকে জীবনের অভ্যাসে পরিণত করে, সে দুঃখে হাসতে শেখে, অন্ধকারে আলোর সন্ধান পায়।
আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে তওবা
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ডেকে বলেছেন, হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের প্রতি সীমালঙ্ঘন করেছে, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করে দেন। (সূরা যুমার: ৫৩)
এই আয়াতকে বলা হয় ‘আয়াতে রাজা’, অর্থাৎ আশা জাগানো আয়াত। কারণ এতে বলা হয়েছে, কোন পাপই এমন নয় যা আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন না। আল্লাহর দরজা সর্বদা খোলা, শুধু দরজায় কড়া নাড়ার সাহসটাই লাগে। তওবা হলো সেই কড়া নাড়া, আর ইস্তিগফার হলো দরজা খোলার চাবি।
আত্মশুদ্ধি ও মানসিক প্রশান্তি
যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তিগফার পড়ে, তার অন্তরে প্রশান্তি নেমে আসে। পাপের বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে সে এক ধরনের হালকা অনুভব করে। মনোবিজ্ঞানীরাও বলেন, অনুশোচনা ও ক্ষমা প্রার্থনা মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক। তওবা একদিকে আত্মার চিকিৎসা, অন্যদিকে মানসিক স্বস্তির উৎস।
যেমন, রাতে শুয়ে যখন কেউ বলে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ তখন তার হৃদয় থেকে একেকটি কালো দাগ মুছে যায়, মন নরম হয়, দৃষ্টি পরিষ্কার হয়, আর আত্মা ফিরে পায় আল্লাহর সান্নিধ্যের মিষ্টতা।
ইস্তিগফারের গুণাগুণ
পাপ মোচন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ: ইস্তিগফার আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় আমলগুলোর মধ্যে একটি। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অবলম্বনকারীদের ভালোবাসেন। (সূরা বাকারা: ২২২)
রিজিক ও বরকতের বৃদ্ধি: নূহ (আ.) এর বাণী অনুযায়ী, ইস্তিগফার রিজিক বৃদ্ধি করে, বৃষ্টি বর্ষণ করে, অর্থনৈতিক স্বস্তি আনে।
দুঃখ ও বিপদ থেকে মুক্তি: রাসুল (সা.) বলেছেন, যে নিয়মিত ইস্তিগফার করে, আল্লাহ তার সব দুঃখ থেকে মুক্তি দেন। অর্থাৎ, ইস্তিগফার হলো এক ধরনের আত্মিক ঢাল।
আত্মা ও সমাজের পরিশুদ্ধি: ব্যক্তি যখন তওবা করে, তখন সে নিজের ভুল বুঝে সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হয়। এতে সমাজে নৈতিকতা ও শুদ্ধতার চর্চা বাড়ে।
ইস্তিগফার কেন পড়া ভালো
আমরা প্রতিদিন নানা ভুল করি যকিনা চোখের, কানের, জিহ্বার, কিংবা মনের। এসব ভুলের ভার দিনে দিনে হৃদয়কে শক্ত করে ফেলে। ইস্তিগফার সেই হৃদয়কে নরম করে, আল্লাহর দিকে ফেরায়।
যেমন, যে মানুষ নিয়মিত গাড়ি পরিষ্কার না করলে ধুলো জমে, তেমনি আত্মাকে যদি প্রতিদিন ইস্তিগফারের জলে ধোয়া না হয়, তবে তা মলিন হয়ে যায়। তাই ইস্তিগফার হলো আত্মার ধোয়া, চিন্তার শুদ্ধি, ও জীবনের নবায়ন।
কিছু উপকারী দোয়া
রাসুল (সা.) যেসব ইস্তিগফার পাঠ করতেন, তার মধ্যে কয়েকটি বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ—
আস্তাগফিরুল্লাহ রাব্বি মিন কুল্লি জান্বিন ওয়া আতুবু ইলাইহ।
অর্থ: আমি আল্লাহর নিকট আমার সব পাপের ক্ষমা চাই এবং তাঁর দিকেই ফিরে আসি।
সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার, আল্লাহুম্মা আন্তা রাব্বি, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা, খালাকতানি ওয়া আনা ‘আবদুক… (পূর্ণ দোয়াটি সহিহ বুখারিতে বর্ণিত)।
রাসুল (সা.) বলেছেন, যে এই দোয়া সকালে দৃঢ় বিশ্বাসে পাঠ করবে এবং রাতে মৃত্যুবরণ করবে, সে জান্নাতি হবে। আল্লাহর দিকে ফিরে আসার ডাক
আজকের ব্যস্ত জীবনে আমরা ভুলে যাই, আল্লাহর ক্ষমা কত সহজলভ্য। আমরা মানুষকে খুশি রাখতে সব কিছু করি, কিন্তু যিনি আমাদের জীবন দিয়েছেন, তাঁকে খুশি রাখার চেষ্টাই করি না। অথচ আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ খুবই সহজ: তওবা ও ইস্তিগফার।
প্রতিদিন অন্তত কিছু সময় নিরিবিলি বসে নিজের ভুলের হিসাব নেওয়া, মুখে “আস্তাগফিরুল্লাহ” উচ্চারণ করা, আর মনে অনুশোচনার অশ্রু ঝরানো এই ছোট আমলই আল্লাহর কাছে আমাদের বড় করে তোলে।
আল্লাহ বলেন, যে তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তার পাপকে সৎকর্মে পরিণত করে দেন। (সূরা ফুরকান: ৭০)
তওবা তাই শুধু ক্ষমা প্রার্থনা নয়, এটি জীবনের নতুন সূচনা। ইস্তিগফার শুধু ভাষার দোয়া নয়, এটি আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর সন্তুষ্টির সিঁড়ি।
![]()